গবেষণা নকশার সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ আলোচনা কর
ভূমিকা: কোনকিছুর অনুসন্ধান হলো গবেষণা। গবেষণা নকশা হলো সামাজিক গবেষণার একটি ধাপ বা পর্যায়। যে কোন গবেষণা ক্ষেত্রে নকশা গঠন বাধ্যতামূলক। কেননা, গবেষণার লক্ষ্য হলো কোন নির্ধারিত লক্ষ্যে শুধু পৌঁছে যাওয়াই নয়, তার যৌক্তিক ভিত্তি, ভূমিও প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ, গবেষণার মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধান্তকে নতুনত্বের আঙিনায় রাঙিয়ে দেওয়াই নয় তাকে বিশ্বাসযোগ্য করেও তুলতে হবে। এই দায়িত্বশীল কর্মসূচির একটি পরিকল্পনা থাকা উচিত। তা না হলে নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌছানো নাও হতে পারে। গবেষণাক্ষেত্রে নিয়োজিত এই পরিকল্পনাই গবেষণা নকশা হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থাৎ, গবেষণার নকশা হলো তার নির্বাচন ও ব্যবস্থাপনার অবস্থা।
গবেষণা নকশার সংজ্ঞা: গবেষণা নকশার ইংরেজি প্রতিশব্দ Research Design. Research শব্দের অর্থ গবেষণা। এবং Design শব্দের অর্থ 'নকশা'। এই দুটি' শব্দের মিলিত রূপকে একত্রে গবেষণা নকশা বলা হয়। এটাকে গবেষণার Blue print বা নীল নকশাও বলা হয়। মূলত গবেষণা নকশা হলে গবেষণার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য সঠিক ও যথাযথ পদ্ধতির সাহায্যে তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য বিশ্লেষণের প্রক্রিয়া।
প্রামান্য সংজ্ঞা: বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী এবং গবেষক বিভিন্নভাবে গবেষণা নকশার সংজ্ঞা দিয়েছেন। নিম্নে উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞাগুলো প্রদান করা হলো:
Fred N. Kerliner এর মতে, "গবেষণা নকশা হচ্ছে গবেষণা সংক্রান্ত প্রশ্নপত্রের উত্তর পাবার উপায় এবং চলকসমূহের নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা ও কাঠামো।"
কার্লস্মিথ বলেছেন, "কোন পরীক্ষণের নকশা বলতে বুঝায় তার নির্বাচন ও ব্যবস্থাপনার অবস্থা।"
ব্লাক ও চ্যাম্পিয়ন বলেছেন, "গবেষণা নকশা হচ্ছে এমন একটা পরিকল্পনা যাতে তথ্য কিভাবে সংগৃহীত ও বিশ্লেষিত হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয় এবং গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে প্রক্রিয়াধীন অর্থনীতির সমন্বয় সাধন করা হয়।"
P. V. Young এর মতে, "গবেষণা নকশা হচ্ছে গবেষণা কর্মের এক যৌক্তিক এবং পদ্ধতিনিষ্ঠ পরিকল্পনা এবং পরিচালনা।"
ক্লেয়ার সেলটিজ বলেছেন, "পরিমিত প্রক্রিয়ায় গবেষণার উদ্দেশ্যের সাথে সঙ্গতিপূর্ণভাবে উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের লক্ষ্যে বিভিন্ন শর্তের বিন্যাস রাখাই হলো গবেষণা নকশা।"
ই. আর. স্যম্যান এর মতে, "গবেষণা নকশা এমন একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নয় যা বিচ্যুতি ছাড়াই অনুসরণ করা হবে; বরং কাউকে সঠিক পথে রাখার জন্য কতিপয় নির্দেশক স্তম্ভের ক্রমবিন্যাস মাত্র।"
রালক এবং ব্লালক বলেছেন, "নকশা হলো কিছু সাধারণ নির্দেশনার সন্নিবেশ যার মধ্যদিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ কোন গবেষণা পরিচালিত হয়।"
উপরিউক্ত সংজ্ঞার আলোকে বলা যায় যে, কোন গবেষক তার গবেষণা কার্যক্রম শুরু করতে গিয়ে কখন, কিভাবে, কার কাছ থেকে, কত সময় অর্থ ও শ্রম ব্যয়ে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের মধ্যে দিয়ে অনুমান যাচাই ও গবেষণার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছাতে পারবেন সে বিষয়ে বাস্তব চিন্তাভাবনা করে বিজ্ঞানভিত্তিক যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন তাকেই গবেষণা নকশা বলা হয়।
গবেষণা নকশার প্রকারভেদ সম্পর্কে লিখ।
ভূমিকা : গবেষণা হলো একটি অনুসন্ধানমূলক কাজ। আর গবেষণা নকশা হলো গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। যেকোন গবেষণা করতে গেলে সর্বপ্রথম গবেষণা নকশার কথা চিন্তা করতে হবে। কেননা, গবেষণা নকশার উপর গবেষণার সফলতা ও ব্যর্থতা নির্ভর করে। একজন গবেষক তার কাজের সুবিধার জন্য গবেষণার পূর্বে যে পরিকল্পনা তৈরি করেন তাকে গবেষণা নকশা বলে। কোন কাজকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করতে গেলে গবেষণা নকশা প্রয়োজন। নকশা ছাড়া কোন গবেষণা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে না। সুতরাং, গবেষণা নকশার উপরই এর সফলতা নির্ভর করে।
গবেষণার নকশার প্রকারভেদ: গবেষণা নকশা হলো কোন গবেষণার পূর্ব পরিকল্পনা। নিম্নে গবেষণার প্রকারভেদ আলোচনা করা হলো:
গবেষণা নকশাকে Fisher, Lating & Stocekel-এর মতে, তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
যথা- (ক) পরীক্ষণমূলক নকশা; (খ) আপাত পরীক্ষণমূলক নকশা ও (গ) অপরীক্ষণমূলক নকশা।
(ক) পরীক্ষণমূলক নকশা: পরীক্ষণমূলক নকশায় দুটি চলক থাকে। স্বাধীন চলক যা কোন হিসেবে বিবেচিত হয় এবং অপর চলক অধীন যা কার্য হিসেবে বিবেচিত হয়। স্বাধীন চলকের মাত্রার পরিবর্তন করে স্বাধীন চলক কতটুকু প্রভাবিত হয় তা পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপ করা হয়। এ নকশায় স্বাধীন চলক ছাড়া অন্যান্য চলক নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়।
(খ) আপাত পরীক্ষণমূলক নকশা: এটি পরীক্ষণমূলক নকশার আশ্রয়ে থাকে। এ নকশার অংশগ্রহণকারীর গবেষককে বিভিন্ন শর্তে দৈবচয়ন পদ্ধতির আশ্রয় নিতে হয়। এতে বিভিন্নভাবে বিভাজিত হয়ে কাজ করতে হয়।
(গ) অপরীক্ষণমূলক নকশা: সমাজ গবেষকগণ সাধারণত বর্ণনামূলক তথ্য সংগ্রহ বা বিশেষ পরিস্থিতির পর্যালোচনার জন্য এ ধরনের নকশার আশ্রয় নেন। অপরিক্ষণমূলক নকশা মূলত পূর্ব পরীক্ষণ নকশা ও জরিপ নকশা হিসেবে বিবেচিত হয়। সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন ঘটনা, অবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন চিত্র তুলে ধরার জন্য এ নকশা ব্যবহার করা হয়।
পরীক্ষণমূলক নকশা: পরীক্ষণমূলক নকশা সম্পর্কে S. Chaplen বলেন, "পরীক্ষণ হলো নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ কোনো কিছু পর্যবেক্ষণ করা।" পরীক্ষণমূলক নকশাকে বিভিন্ন মতামতের ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ নিম্নে আলোচনা করা হলো:
উইলকিনসন ও ডানদাবের মতে, পরীক্ষণমূলক নকশা দুই প্রকার:
(ক) অভিজ্ঞ উত্তর যাচাই মাত্রা নকশা: এখানে পরীক্ষণীয় বলে নিয়মিত এবং পরীক্ষণ উন্মুক্ত করার পরবর্তীতে মাত্রা নির্ভরশীল বলে পরিমাপ নেওয়া হয়।
(খ) পূর্বাপর যাচাই নকশা: এখানে দল বা দলসমূহকে পরীক্ষণীয় বলে উন্মুক্ত করার পূর্বে এবং পরে নির্ভরশীল বলে পরিমাপ নেওয়া হয়ে থাকে।
লিন্ডকুইস্ট এর মতে, পরীক্ষামূলক নকশাকে ৬ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
১. সরল দৈবচয়িত নকশা: এ নকশা পরীক্ষণীয় বলে প্রতিটি মাত্রা আলাদা আলাদা নমুনা বলের উপর পুরোপুরিভাবে প্রয়োগ করা হয়।
২. উপাদানমূলক নকশা: উপাদানভিত্তিক নকশার দুই বা তার অধিক পরীক্ষণীয় বলের প্রভাব ও পারস্পরিক ক্রিয়া যুগপৎভাবে লক্ষ্য করা যায়।
৩. দৈবচয়িত পুনরাবৃত্তিমূলক নকশা: নানারকম পুনরাবৃত্তিতে ব্যবহৃত পরীক্ষণ পাত্র একই সামগ্রিক হতে নেওয়া যেতে পারে এবং প্রত্যেক পুনরাবৃত্তির পরীক্ষণ বা দৈবচয়ন পদ্ধতিতে একটি ভিন্ন ও দৈবচয়িতভাবে নির্বাচিত উপসামগ্রিক থেকে নেওয়া যেতে পারে
৪. পরীক্ষণীয় বলের স্তরভিত্তিক নকশা: নির্ণায়কের সাথে সম্পর্কিত বলের প্রেক্ষিতে তুল্য নকশা দলগুলোর উপর নানাবিধ পরীক্ষণীয় বলের মাত্রা প্রয়োগ করে।
৫. আজাদলীয় বহুমাত্রিক নকশা: এ নকশা সমগ্র থেকে বহুসংখ্যক পরিমেয় দান নিয়ে গঠিত যা অনুধ্যানের আওতাধীনে পড়ে।
৬. পরীক্ষণীয় বলের বিভিন্ন মাত্রা এবং অংশ পরীক্ষণ পাত্রের নকশা: পরীক্ষণীয় বলের সমস্ত মাত্রা একই পরীক্ষণ পাত্রের উপর ক্রমান্বয়ে প্রয়োগ করা হয়।
ম্যাক গুইগান এর মতে পরীক্ষণমূলক নকশা ৫ প্রকার:
১. দৈবচয়িত দ্বিদলীয় নকশা: কোন অনির্ভরশীল চলকের নির্বাচনের পর গবেষক যখন কোন আচরণের উপর নির্ভরশীল চলকের দুটি মাত্রা প্রয়োগ করে দেখতে চান যে, অনির্ভরশীল চলকের দুটি মাত্রা সংশ্লিষ্ট আচরণকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করে।
২. তুল্য দ্বিদলীয় নকশা: পরীক্ষণে অংশগ্রহণকারী দৈবচয়িতভাবে দুটি দলে ন্যস্ত করায় দুটি সমদল পাওয়া যায় যা দুদলীয় নকশায় ধরে নেওয়া হয়।
৩. দৈবচয়িত বহুদলীয় নকশা: কোন পরীক্ষণে যখন তিন বা তার বেশি শর্ত থাকে অথবা যখন তিন বা তার বেশি চলকের পরীক্ষণ পাত্রের উপর প্রয়োগ করা হয় তখন বহুদলীয় নকশা ব্যবহার করা হয়।
৪. উপাদানভিত্তিক নকশা: এ নকশা হলো দুই ততোধিক অনির্ভরশীল চলের প্রভাব অনুসন্ধানের একটি নকশা।
৫. আন্তঃদলীয় নকশা: আন্তঃদলীয় নকশায় ভিন্নভাবে ব্যবহৃত দলগুলোর মাঝে নির্ভরশীল চলে সাফল্যের তুলনা করা হয়। এতে অনির্ভরশীল চলের দুই বা ততোধিক মাত্রা একই পরীক্ষণ পাত্রে ক্রমান্বয়ে প্রয়োগ করা হয়।
উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, গবেষণা নকশা হলো। এমন একটি পূর্ব পরিকল্পনা যা কোন গবেষণা কাজের পূর্বে করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, একটি গবেষণা কতটুকু যৌক্তিক ও তাৎপর্য তা একমাত্র গবেষণার নকশার উপরই নির্ভর করে। আর এ গবেষণা নকশাকে বোঝার জন্য একে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। কেননা, বিজ্ঞানসম্মতভাবে জ্ঞান অন্বেষণ অথবা অনুভূত সমস্যা সমাধান কল্পে সমাজ গবেষককে সমাধান কাজের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়।